ফ্রিল্যান্সিং বনাম কর্মসংস্থান: ভাল ক্যারিয়ার কোনটি?

ইদানীং অনেকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে এবং নিজের বস হওয়ার জন্য চাকরি ছেড়ে দিচ্ছে । ফ্রিল্যান্সিং এবং অনলাইন ইনকামের উপায়গুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠার সাথে সাথে এই প্রবণতা বছরের পর বছর আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

কিন্তু এটি কি সত্যিই একটি স্মার্ট ধারণা? আপনার কোনটি পছন্দ তা নিশ্চিত নন? আজকের পোস্টে একজন কর্মচারী হওয়ার এবং একজন ফ্রিল্যান্সার হওয়ার কিছু সুবিধা এবং অসুবিধা তুলে ধরবো যাতে করে আপনি সহজেই সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারেন।

ফ্রিল্যান্সিং এর সুবিধা এবং অসুবিধা

ফ্রিল্যান্সিং এর সুবিধা

১. সময় বাঁচায়

যেহেতু ফ্রিল্যান্সারদের অফিসে যাতায়াতের প্রয়োজন নেই, তাই প্রতি মাসে অনেক ঘন্টা বাঁচে। এই অতিরিক্ত সময়টি প্রিয়জনের সাথে কাটানো, নতুন স্কিল শিখা, অতিরিক্ত প্রকল্প গ্রহণ করা, স্বেচ্ছাসেবী কাজে অংশ নেওয়া বা অন্যান্য ক্রিয়াকলাপ করা যেতে পারে।

২. ইচ্ছা অনুযায়ী কাজের সময় নিয়ন্ত্রণ করা যায়

ফ্রিল্যান্সাররা নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার বেড়াজালে আবদ্ধ নন যা একজন কর্মচারীকে মেনে চলতে হবে। আপনি যখন সবচেয়ে বেশি উৎপাদনশীল বোধ করেন তখন আপনার সময়সূচী নিয়ন্ত্রণ করার এবং কাজ করার স্বাধীনতা আপনার আছে।

৩. নিজের শর্তাবলী অনুযায়ী কাজ করতে পারা

একজন সফল ফ্রিল্যান্সার নিজের নিয়ম অনুযায়ী কাজ করতে সক্ষম হয়। আপনাকে নিয়োগকর্তার দ্বারা নির্ধারিত নীতিগুলি মেনে চলতে হবে না; আপনার নিজের শর্ত তৈরি করতে এবং ক্লায়েন্টদের সাথে আলোচনা করে চুক্তি করার নিয়ন্ত্রণ আপনার আছে।

৪. ইনকামের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে

একজন কর্মচারীর আয় নির্দিষ্ট হয়, সেই আয়ে আপনার বস বা নিয়োগকর্তার হাতে থাকে। কিন্তু ফ্রিল্যান্সিং এ সেই নিয়ন্ত্রণ আপনার হাতে থাকে এবং আপনি স্বাধীনভাবে নিজের সিদ্ধান্তনিতে পারেন। আপনি স্ব-মূল্যায়ন এবং বাজার গবেষণার মাধ্যমে আপনার নিজস্ব ফ্রিল্যান্স রেট সেট করতে পারেন।

৫. সব লাভ ফ্রীলান্সারদের হাতে আসে 

যেহেতু আপনি সরাসরি ক্লায়েন্টদের সার্ভিস দিয়ে থাকেন, সেহেতু কোনো মধ্যস্থতার প্রয়োজন নেই। এর অর্থ হল আপনার শ্রম থেকে উৎপন্ন সমস্ত আয় সম্পূর্ণরূপে আপনার, কোনো নিয়োগকর্তার নয়। কঠোর পরিশ্রম দ্বারা যা আয় করুন না কেন, তা সরাসরি আপনার কাছে যায়।

যাইহোক, মনে রাখবেন যে আয়ের একটি অংশ নতুন কাজের সরঞ্জাম কেনার বা বিসনেসে ইনভেস্টের জন্য ব্যয় করুন। তবে ফাইভারের মতো ফ্রীল্যানসিং মার্কেটপ্লেস গুলো ব্যবহার করলে আপনাকে একটি নির্দিষ্ট % কমিশন দিতে হবে তাদের। কিন্তু মার্কেটপ্লেসের বাইরে কাজের সুবিধা হলো সেখানে কাউকে কমিশন দিতে হয় না। 

ফ্রিল্যান্সিং এর অসুবিধা

১. অনেক বেশি দায়িত্ব পালন করতে হয়

আপনি যদি একজন ফ্রিল্যান্সার হন তবে আপনাকে মূল কাজের পাশাপাশি আরো অনেকদিক ম্যানেজ করতে হবে যেমনঃ মার্কেটিং করা, ক্লায়েন্ট সন্তুষ্টি, অ্যাকাউন্টিং, ট্যাক্স প্রদান, প্রশাসনিক কাজ, ফ্যামিলি ম্যানেজ ইত্যাদি। 

২. সামান্য আর্থিক নিরাপত্তা

ফ্রিল্যান্সারদের আয়ের নিশ্চয়তা না থাকায় তারা চাকুরিজীবীদের মতো একই স্তরের আর্থিক নিরাপত্তা উপভোগ করেন না। এই অনিশ্চয়তা পথকে কঠিন করে তোলে এবং নতুন ফ্রিল্যান্সারদের ঝুঁকি নেওয়া থেকে নিরুৎসাহিত করতে পারে।

৩. একা অনুভব করা বা একগেঁয়ে হয়ে যাওয়া

ফ্রিল্যান্সারদের আশেপাশে সহকর্মী থাকে না ফলে তারা খুব সহজেই একা অনুভব করতে পারে। এতে অলসতা ও আসতে পারে। এটি মোকাবেলা করার একটি ভাল উপায় হল প্রিয়জনদের জন্য সময় আলাদা করা।

৪. অসামঞ্জস্যপূর্ণ কাজের চাপ

চাকুরীজীবীরা একটি নির্দিষ্ট কাজ প্রতিদিন করতে থাকে। সুতরাং তাদের কর্মপ্রবাহ মোটামুটি স্থিতিশীল এবং অনুমানযোগ্য। ফ্রিল্যান্সিং করার সময় সেটা হয় না।  ফ্রিল্যান্সাররা পরের প্রকল্পগুলি খুঁজে পেতে সংগ্রাম করতে হয় এবং পরবর্তী প্রজেক্টটি কি হবে সেটাও জানে না।

৫. কাজ করার জন্য স্ব-আরোপিত চাপ

নিজের বস হওয়া যতটা দুর্দান্ত শুনায় তা এতটাও সহজ নয়। আপনার কাছে কোন ম্যানেজার নেই সুতরাং নিজেকেই সেই শূন্যতা পূরণ করতে হবে। অনেক সময় আপনার অবসর সময় উপভোগ করা বাদ দিয়ে কাজ করতে হতে পারে। সুতরাং একটি সময়সূচী তৈরি করতে ভুলবেন না।

Related: ফ্রিল্যান্সিং বনাম কর্মসংস্থান: ভাল ক্যারিয়ার কোনটি?

চাকুরীজীবি হওয়ার সুবিধা এবং অসুবিধা

কর্মচারী হওয়ার সুবিধা

১. অধিক সুযোগ-সুবিধা এবং বিশেষত্ব

কর্মচারীরা অধিক সুবিধা এবং সুযোগ ভোগ করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে মাসিক ছুটি, প্রতিদান, ভাতা, পিতামাতার ছুটি, স্বাস্থ্য বীমা, অবসর পরিকল্পনা, পেনশন এবং আরও অনেক কিছু।

২. প্রতিমাসে নিৰ্দিষ্ট বেতন চেক পাওয়া যায়

ফ্রিল্যান্সারের চেয়ে একজন কর্মচারী হওয়ার সবচেয়ে সুস্পষ্ট সুবিধা হল এটি আর্থিক নিরাপত্তা প্রদান করে। প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট বেতন চেক আপনাকে সহজে বিশ্রাম নিতে দেয়। এতে করে আপনার ভবিষ্যত সুরক্ষিত থাকে। এমনকি আপনি যদি কিচুদিন অসুস্থ থাকেন বা কোম্পানিটি এই বছর কোনো লাভ নাও করে, তবুও আপনাকে অর্থ প্রদান করা হবে।

৩. ধারাবাহিকভাবে ইনকাম বৃদ্ধি হয়

কর্মচারীদের বেতন একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর বৃদ্ধি হতে পারে। কিন্তু একজন ফ্রিল্যান্সারের ইনকাম কোনো মাসে কম আবার কোনো মাসে বেশি হতে পারে।

৪. সহজেই আয়ে ব্যায়ের বাজেট করা যায় 

যেহেতু কর্মচারীর বেতন স্থির এবং অনুমানযোগ্য, সেহেতু পরিবারের জন্য বাজেট করা সহজ হয়। তারা আয়ের অংশগুলিকে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে যেমন প্রয়োজন, চাওয়া, সঞ্চয়, বিনিয়োগ এবং জরুরী অবস্থার মধ্যে ভাগ করতে পারেন।

৫. সামাজিক দক্ষতা বিকাশ করে

কর্মচারীদের সামাজিক দক্ষতা বেশি ও উন্নত থাকে, কারণ আপনি ক্রমাগত আপনার সহকর্মীদের এবং আশেপাশের মানুষের সাথে কথোপকথনে জড়িত থাকেন। এটি কাজের সাথে সম্পর্কিত কিছু বা সম্পূর্ণ অন্য কিছু সম্পর্কে হোক না কেন, একজন কর্মচারী হওয়া আপনাকে  আপনার সামাজিক দক্ষতাকে প্রশিক্ষণ দিতে এবং মানসিক বুদ্ধিমত্তা বাড়াতে পারে।

চাকুরীজীবি হওয়ার অসুবিধা

১. বসের সমালোচনা বা কটু কথা শুনতে হয়

অনেক ব্যবস্থাপক এবং তত্ত্বাবধায়ক তাদের অধীনস্থদের মাইক্রোম্যানেজ করার প্রবণতা রাখেন, অর্থাৎ, তাদের ক্ষুদ্রতম ক্রিয়াকলাপ নিরীক্ষণ করেন এবং কাজ ১০০% পারফেক্ট না হলে তাদের সমালোচনা করেন। অন্য কথায়, তারা এটা যেভাবে চায় সেভাবে না হলে অনেক কটু কথা শুনতে হয়।

২. সীমিত বেতন এবং তা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়

যদিও একটি স্থিতিশীল আয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তবে বেশিভাগ সময় এটি আপনার অনেক শখ ও প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে পারে না।

৩. কাজের সময় নির্দিষ্ট থাকে

একজন কর্মচারীর সবচেয়ে অস্বস্তিকর বিষয় হল নিয়ন্ত্রিত সময়সূচি। নির্দিষ্ট কাজের সময় রয়েছে যা আপনাকে মেনে চলতে হবে। অন্য কথায়, আপনার সময়ের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই। আপনি চাইলেই আপনার মন মতো ছুটি নিতে পারবেন না।

পাশাপাশি বেতন বৃদ্ধির জন্য কর্মচারীদের পুরো বছর অপেক্ষা করতে হয়। আবার আপনি বেতন বৃদ্ধির জন্য জিজ্ঞাসাও করতে পারবেন না।  যা হতাশাজনক হতে পারে। অনেকসময় দক্ষতা অনুযায়ীই বেতন পাওয়া যায় না। 

৪. কোম্পানির নীতি দ্বারা আবদ্ধ থাকতে হয়

কর্মচারীরা সবসময় নিয়োগকর্তার শর্তাবলী এবং নীতির বেড়াজালে আবদ্ধ।  আপনি যদি নীতিগুলি সঠিকভাবে মেনে চলতে ব্যর্থ হন তবে আপনি কিছু প্রতিক্রিয়ার শিকার হতে পারেন।

৫. কর্মস্থলে যাতায়াত করতে হয়

কাজে যাতায়াত করলে আপনার সময়, শক্তি এবং অর্থ ব্যায় হয়। এটি শুধুমাত্র আপনার কাজের সময় নষ্ট করে না, এটি আপনাকে ক্লান্ত করে এবং শরীরের জ্বালানীতে অর্থ ব্যয় করতে বাদ্য করে। আপনি যদি রিমোট জব না করেন, যাতায়াত একটি সমস্যা।

ফ্রিল্যান্সিং বনাম কর্মসংস্থান: OnlineGuruBD এর শেষ কথা

ঐতিহ্যগত কর্মসংস্থান এবং ফ্রিল্যান্সিং এর মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া ব্যক্তিগত পছন্দ, ক্যারিয়ারের লক্ষ্য এবং জীবনধারা পছন্দের উপর নির্ভর করে। 

যদিও ঐতিহ্যগত কর্মসংস্থান স্থিতিশীলতা এবং সুবিধা প্রদান করে, ফ্রিল্যান্সিং নমনীয়তা এবং স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে। 

পরিশেষে, সর্বোত্তম ক্যারিয়ার পছন্দ ব্যক্তিগত পরিপূর্ণতা, আর্থিক লক্ষ্য এবং কাঙ্ক্ষিত কর্ম-জীবনের ভারসাম্যের মতো বিষয়গুলির উপর নির্ভর করে।

প্রতিটি বিকল্পের সুবিধা এবং অসুবিধাগুলি সাবধানতার সাথে বিবেচনা করে লোকেরা তাদের অনন্য পরিস্থিতি এবং আকাঙ্ক্ষার উপর ভিত্তি করে জ্ঞাত সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

আপনি নাইন-টু-ফাইভ-এর কাঠামো বা ফ্রিল্যান্সিংয়ের স্বাধীনতা বেছে নিন না কেন, আপনার সাথে সবচেয়ে বেশি খাপখায় এরকম  পথটিকে বেছে নিয়ে আপনি একটি পরিপূর্ণ ক্যারিয়ার যাত্রা অর্জন করতে পারেন।

Dilwala Shakil
Dilwala Shakil

আমি মোঃ গোলাম রাব্বানী, এই ওয়েবসাইটের মালিক এবং লেখক। বিগত ৫-৬ বছর ধরে ফ্রিল্যান্সিং, ওয়েব ডিসাইন, ব্লগিং, এফিলিয়েট মার্কেটিং, ডিজিটাল মার্কেটিং ইত্যাদি করে অনলাইনে ইনকাম করতেছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে, নতুনদের অনলাইনে ইনকাম ও ফ্রিল্যান্সিং রিলেটেড বিভিন্ন ফ্রি টিপস এবং রিসোর্স শেয়ার করবো যাতে আমার দেশের মানুষেরা সবকিছু ফ্রীতে শিখে নিজেদের সাবলম্বী করতে পারে।

Articles: 23

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *